অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা:
শিয়ালদহ থেকে মেইন শাখার ট্রেনে উঠলে এখন যাত্রীদের মুখে একটাই আলোচনা শোনা যায়। তা
হল এবার ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের ভোট কোন দিকে-পদ্ম না কি জোড়া ফুলে যাবে। আগে
হকারদের ভিতর এ নিয়ে আগ্রহ দেখা যেত না।
কিন্তু এবার সেই সব হকাররাও কেউ বাদাম, কেউ
মশাল মুড়ি মাখার ফাঁকে ওই আলোচনার মাঝে ফুট কাটছেন। যাত্রীরা তাড়িয়ে তাড়িয়ে তা উপভোগ
করছেন। মাঝে মাঝে কেউ কেউ উসকে দিচ্ছেন খোঁচা দিয়ে কথা বলে। ভোটের উত্তাপ নেওয়ার জন্য
ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল যাওয়ার সময় শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে উঠতেই কামরায় এই ছবি দেখা গেল।
দেখলাম, তাস খেলা ছেড়ে অনেকে পদ্ম প্রার্থী অর্জুন সিং এবং জোড়া ফুলের প্রার্থী পার্থ
ভৌমিককে নিয়ে তুমুল বিতর্কে জড়িয়ে গিয়েছেন। একজন মাঝ বয়সী যাত্রী বলছেন, এখানে অর্জুন
হল একজন হেভিওয়েট প্রার্থী। তাঁর সঙ্গে কোনও ভাবে পাল্লা দিতে পারবে না পার্থ ভৌমিক।
দেখে নেবেন, এবারও পদ্ম-র হাতেই থেকে যাবে ব্যারাকপুর।
পাল্টা একজন বললেন, এবার সেই
সুবিধা পাবে না অর্জুন। এবার জোড়া ফুলের দিকে পাল্লা ভারি। মাঝ বয়সী যাত্রী তাঁর বিরোধী
বক্তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, যুক্তি ছাড়া কথা বলবেন না। আসলে অর্জুনের দীর্ঘদিন ধরে
এতদঞ্চলের রাজনৈতিক জমি চাষ করে রাজনীতিতে টিকে আছেন। বাম শাসনের সময়ও দাপট ছিল
তাঁর।
ব্যারাকপুরের ত্রাস ও দাপুটে সিপিএমের শিক্ষক নেতা ও সাংসদ ছিলেন তরিৎ তোপদার।
সেই সময়ও তৃণমূল অন্তপ্রাণ অর্জুন সিং ভাটপাড়ার বুকে দাপটের সঙ্গে ছড়ি ঘুরিয়ে ছেন।
বিধায়ক হয়েছেন। কখনও পুরসভার চেয়ারম্যান হয়েছেন। তরিৎবাবুও র সঙ্গে অর্জুন সিংয়ের
একটা গোপন সখ্যতা আছে। রাজনৈতিকভাবে যাকে বলে গিভ অ্যান্ড টেক পলিসি।
সেই কারণে এত
বাড়বাড়ন্ত ছিল অর্জুনবাবুর। তবে এটাও ঠিক যে, সেই সময় থেকে তিনি এই জায়গাতে রাজনীতি
করেছেন বলে গোটা জায়গাটি চেনা। সেই তুলনায় পার্থ ভৌমিকের মাটির সঙ্গে যোগাযোগ অতটা
নেই। তিনি গান ও নাটক নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকতেন। এক সময় অর্জুন সিংয়ের ভাবশিষ্য হিসেবে
নৈহাটি থেকে কাজ করতেন। স্টেশন আড্ডা মারা থেকে ওই চত্বরের ভিতর তার বিস্তার ছিল।
গোটা ব্যারাকপুরে নয়। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় আসার পর এই গোটা এলাকা যখন ( বিজেপিতে
চলে যাওয়াতে) অর্জুন সিং হীন হল তখন যুব তৃণমূল ব্যানারে উত্থান হল পার্থবাবুর। তারপর
সেচমন্ত্রী হওয়াতে তাঁর ওজন বেড়ে গেল। কিন্তু জনসংযোগের ক্ষেত্রে তিনি বরাবর পিছিয়ে
রয়েছেন। মন্ত্রী সেদিক থেকে অর্জুন এখনও এগিয়ে। পাশ থেকে আরও একজন যুবক যাত্রী ফুট
কাটল।
বললো, এবার অর্জুনের ইমেজ অনেকটাই নীচের দিকে। কারণ, উনি একবার বিজেপিতে গিয়ে
সাংসদ হলেন। পদ্ম অনুগতরা ওঁনাকে ভোট দিল। কিন্তু ভোটারদের বিশ্বাস ভেঙে তিনি একবছর
পর ফের পদ্ম ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিলেন। আবার এই লোকসভা ভোটের আগে বিজেপিতে এসে টিকিট
নিয়ে প্রার্থী হয়েছেন। এটা ভোটাররা ভালোভাবে মেনে নিতে পারেনি।
এখন এমন পরিস্থিতি হয়েছে
যে, এবার যদি বিজেপি থেকে দাঁড়ালেও কেউ ওঁনাকে মন থেকে মেনে নিতে পারছেন না। তার চেয়ে
নতুন কোনও মুখকে প্রার্থী করলে বিজেপি ঢ্যাং ঢ্যাং করে বেরিয়ে যেত। কারণ, গত কয়েকবছরে
ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপির ভোট অনেক গুণ বেড়েছে। রাম নবমীকে কেন্দ্র করে
সাতটি বিধানসভা তে বিশাল বিশাল মিছিল ও জমায়েত বুঝিয়ে দিয়েছে জোড়া ফুলের সেই দাপট আর
নেই।
এখন চারদিকে রাম নামের ঢেউ। কিন্তু অর্জুনবাবু প্রার্থী হওয়াতে অনেকে মনমরা। কারণ,
উনি সাংসদ হলে ফের বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যাবেন না তার নিশ্চয়তা কোথায়? এই প্রশ্ন তুলেছেন
খড়দহ, টিটাগড়, ব্যারাকপুর, সোদপুর, আমডাঙা, বীজপুর, ভাটপাড়া, জগদ্দল, নোয়াপাড়ার মানুষ।
একজন হকার বাদাম বিক্রি করছিলেন।
তিনি এসব শুনে চুপ করে দাঁড়িয়ে গেলেন। এবার ফুট
কাটলেন তিনি। বললেন, প্রথম দিকে ভোটারদের ভিতর এটা থাকলেও ধীরে ধীরে তা কেটে যাচ্ছে।
দেখে নেবেন, খুব বেশি না হলেও কম ব্যবধানে পদ্ম জিতে যাওয়ার প্রবল সম্ভবনা আছে। যদিও এক মহিলা যাত্রী সহমত হতে পারলেন না।
তিনি বললেন, এবার মানুষ তৃণমূল প্রার্থী পার্থকেই ভোট দিয়ে জিতিয়ে আনবে। সব জায়গাতে তা নিয়ে চর্চা হচ্ছে। জনজীবন তাই চাইছে। পাশাপাশি
এটাও ঠিক যে ব্যারাকপুর এ এবার জোর ফাইটের ভিতর চলে এসেছে পদ্ম ও তৃণমূল। ফলে শেষ
পর্যন্ত কি হতে পারে তা এখন বলা যাবে না।
