বিমল বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা: এটা কি জানা আছে সুন্দরবন জুড়ে এক সময় শুধু বাঘ নয়, বড় বড় হাতির বিচরণ ক্ষেত্র ছিল। এখানেই শেষ নয়, ভালুক থেকে আরও নানা ধরণের বন্যজন্তুদের বাসভূমি ছিল। কিন্তু তারও আগে
উন্নততর সভ্যতা গড়ে উঠেছিল দীর্ঘ সময় ধরে। এই অঞ্চলের মানুষের গড়পড়তা উচ্চতা ছিল সাত ফুট। সেই মতে
তাদের দাঁত ছিল অনেকটা বড়। দেখলে মনে হতে পারে রাক্ষস আর কি। ধর্ম নিয়ে সেই সময়ও এই সব সভ্যতায় সংঘাত হয়েছে। তাতে অবৌদ্ধ ও বৌদ্ধদের ভিতর লড়াই এ ধ্বংস হয়েছে বুদ্ধ-র প্রভাব বিস্তার।
এটাই আসলে সত্য। আর সেই সব সত্য উদঘাটেন নেমেছেন একজন কলকাতার এক ইতিহাস সচেতন বিচারক বিপ্লব রায়। একেবারে নিঃশব্দে তিনি এই কাজ করে যাচেছন। আড়াই থেকে তিন হাজার বছর আগে গোটা সুন্দরবন বিশেষ করে এখন যে জায়গাটি বাঘেদের বিচরণ ক্ষেত্র সেই নদী-নালা ও অসংখ্যা জনহীন দ্বীপে ঘেরা শ্বাপদসঙ্কুল এতদঞ্চল সুসভ্য নগরী ছিল। এখানকার মানুষ যে সব মুদ্রার ব্যবহার করত, তা সোনা ও রূপো দিয়ে তৈরি ছিল। হাত দিয়ে সেই সব মুদ্রাতে দারুণ দারুণ সব নকশা কাটা হত। সেই সময় বড় বড় শিল্পীদের বাস ছিল এই সব নগরীতে। সেই কারণে কালো পাথরের ভাস্কর্য্য একাধিক বিষ্ণু ও দশহাতের মূর্তি পাওয়া যাচ্ছে।
সংসারের নিত্য ব্যবহার্য জিনিস যা পাওয়া গিয়েছে, তাতেও তার প্রমাণ রয়েছে। এই সব দেখে প্রমাণ মিলেছে, এখানে পর পর কুষাণ, শুঙ্গ, পাল থেকে গুপ্ত যুগের সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। জলোচ্ছাস ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে সেই সব একের পর এক উন্নততর সভ্যতা মাটির তলায় চাপা পড়ে গিয়েছে। কিন্তু রহস্যময় এই সব সভ্যতার প্রচুর নির্দশন এখনও সুন্দরবনের টাইগার রিজার্ভ প্রজেক্টের ভিতরকার গভীর জঙ্গলে ছোট ছোট দ্বীপে মাটির তলায় রয়ে গিয়েছে। এমনিতে অনেকদিন ধরে একটি কাহিনী সুন্দরবনে ঘোরাফেরা করে। তা হল, ‘নেতিধোপানির ঘাট’।
মনসামঙ্গল কাব্যের নায়িকা বেহুলা সাপে কাটা তাঁর স্বামীর মৃতদেহ নিয়ে ভেলায় করে যাওয়ার সময় এই ঘাটের কাছে থমকে যান। কারণ, সেই ঘাটে তখন কাপড় কাচছিলেন এক মহিলা ধোপানি। তার পাশে একটি শিশু খুব দুরন্তপনা করছিল। আচমকা বেহুলা দেখতে পান, দুরন্তপনায় বিরক্ত মা আচমকা তার বাচ্চাটিকে নিয়ে মাথা ধরে জলে চুবিয়ে দিতে সে নিঃস্তেজ ও মৃতপ্রায় হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর কাচা শেষ হতেই মহিলা ফের বাচ্চাটিকে জলে ডুবিয়ে দিতেই সে জীবন্ত হয়ে গেল। বেহুলা বুঝলেন এই মহিলা সাধারণ নয়।
ফলে ওই ঘাটের কাছে গিয়ে তার পিছু নিলেন। এরপরের কাহিনী সকলের জানা। ওই মহিলার নাম নেতি ধোপানি। তার নামে এখনও এই ঘাট। এই ঘাট দিয়ে ভিতরে গেলে অনেক দূরে একটি মন্দির আছে। তার অর্থ এক সময় এখানে সভ্যতা ছিল। উন্নততর মানুষের বাস ছিল। তাঁদের ভিতর অনেকে জ্ঞানী ও সিদ্ধপুরুষ ছিলেন। এই সব রহস্যময় দ্বীপ থেকে তারই কিছু প্রত্নতাত্তিক নির্দশন তুলে এনেছেন রাজ্য সরকারের জুডিশিয়াল মিউজিয়াম এবং রিসার্চ সেন্টারের প্রশাসক জেনারেল অ্যান্ড অফিসিয়াল ট্রাস্টি বিচারক বিপ্লব রায়। তিনি সেই সত্য তুলে ধরার চেষ্টা করছেন।
গত ১০ এবং ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি একটি দল নিয়ে প্রত্নতাত্তিক ওইসব বস্তুর সন্ধানে কুলতলি থেকে মৈপীঠ ঘুরে অনেক কিছু সংগ্রহ করেছেন। তার ভিতর রয়েছে হাতির ফসিল, ভালুকের হাড় থেকে অন্য জন্তুদের এতদঞ্চলে বাস করার প্রমাণ। তিনি একজন সাত ফুট মানুষের কঙ্কালের অংশ পেয়েছেন। পেয়েছেন তার লম্বা দাঁতও। তাঁর কথায়, মৈপীঠ এলাকা থেকে একটি কালো পাথরের ভাস্কর্য্য মূর্তি পাওয়া গিয়েছে। যার দশটি হাত। ওইখানকার ভুবনেশ্বরী জয়কৃষ্ণ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক এটি তার হাতে তুলে দিয়েছেন।
যাতে আগামী দিনে ইতিহাসের পড়ুয়া ও গবেষণার কাজে লাগে। একইভাবে ওই এলাকার নগেনাবাদের এক মৎস্যজীবী যাঁর কাজ হল জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে মাছ ধরা। সেই ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরে মাছ ধরার সময় বিভিন্ন জনহীন দ্বীপ থেকে কুষান, শুঙ্গ, পাল ও গুপ্ত যুগের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রচুর জিনিস সংগ্রহ করেছে। তার বাড়িটাই একটা মিউজিয়াম। সেই মৎস্যজীবী
জগদীশ মিদ্দা সেই সব প্রত্নতাত্বিক জিনিস বিচারক বিপ্লব রায়ের হাতে তুলে দিয়েছেন।
যার ভিতর রূপোর মুদ্রা
থেকে বাসন, মাটির নানা ব্যবহার্য জিনিস রয়েছে। বিপ্লববাবু বলেন, আমাদের সরকারি এই মিউজিয়ামে এই সব জিনিস
রেখে গবেষণার কাজ হবে। পাশাপাশি এমন আরও অনেক জিনিস ও ফসিল পাওয়া গিয়েছে যার বিষয় এখনও অজানা। সেই সব জিনিসও বিশেষজ্ঞ দিয়ে যাচাই করা হবে। যাতে আগামী প্রজন্ম সুন্দরবনের অচেনা ও অজানা ইতিহাসকে জানতেপারে।
তাঁর কথায়, সমুদ্র যেভাবে সুন্দরবনকে গ্রাস করতে চাইছে, তাতে আগামী দিনে সেখানকার ছোট ছোট
দ্বীপগুলিকে সুরক্ষা বলয়ের ভিতর আনতে না পারলে সেখানে চাপা পড়ে থাকা প্রাচীন সভ্যতা লুপ্ত হয়ে যাবে। তাই
বাঘ, বাঁদাবন ও ওই সব দ্বীপ রক্ষার জন্য আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। এটাই একমাত্র লক্ষ্য হওয়া
উচিত।