বিশ্ব সমাচার, সুন্দরবন: শনিবার এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে কয়েকশো ব্যঘ্র-বিধবা পরিবারের প্রায় ৪০০ জনের হাতে খাদ্যসামগ্রী, নতুন পোশাক, পড়াশোনার সমগ্রী ও খরচ এবং পুজোর উপহার তুলে দিলেন সুন্দরবনের সমাজসেবী অমল নায়েক।বাসন্তীর শিবগঞ্জে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে বিশিষ্টদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ব্যারাকপুর রামকৃষ্ণ মিশনের সম্পাদক স্বামী নিত্যরূপানন্দ মহারাজ, রাজের প্রাক্তন মন্ত্রী সুভাষ নস্কর,
জেনেসিস হাসপাতলের কর্নধার ডাঃ পূর্ণেন্দু রায়, অভিনেতা দীপাঞ্জন ভট্টাচার্য, রোটারিয়ান সুদীপকুমার দে সহ অন্যান্য বিশিষ্টরা।উল্লেখ্য, পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ সুন্দরবন।ছোটবড় মিলিয়ে ১০২টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত এই সুন্দরবন। ইতিমধ্যে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জন্য সুন্দরবনের ৫৪টি দ্বীপ ধ্বংস হয়ে বিলীন হয়ে গিয়েছে। ৩৫০০ কিলোমিটার নদীবাঁধ বেষ্টিত এই সুন্দরবনের জঙ্গলে প্রায় ৪০০ প্রজাতির গাছ-আগাছা দেখতে পাওয়া যায়।
বিস্তীর্ণ সুন্দরবন এলাকায় প্রায় ৫০ লক্ষের অধিক মানুষের বসবাস। নদীমাতৃক সুন্দরবন এলাকার অধিকাংশ মানুষজন দারিদ্রসীমার নীচে হওয়ায় জীবন উপেক্ষা করে জীবন জীবিকার তাগিদে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের আস্তানা প্রত্যন্ত সুন্দরবনের জঙ্গলে কাঠ, মধু এবং নদীখাঁড়িতে মাছ-কাঁকড়া ধরে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন।একদিকে জলে কুমীর, ডাঙায় বাঘ। পাশাপাশি বাংলাদেশি জলদস্যুদের হামলার মুখোমুখি হতে হয় জীবন বিপন্ন করে।
পরিবারের সদস্যদের মুখে একমুঠো অন্ন তুলে দেওয়ার জন্য জীবন বাজি রেখে সুন্দরবনের গভীর জঙ্গলে গিয়ে অনেকেই বাঘের খাদ্যে রূপান্তরিত হয়েছেন। আবার কেউ কেউ অসীম সাহসের জন্য মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে এলেও কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন। কেউবা পঙ্গু হয়ে পরিবারের কাছে বোঝা হয়ে কোনও প্রকারে দিনযাপন করছেন। এমন মানুষের দেখা মেলে প্রত্যন্ত সুন্দরবনের ঝড়খালি, গোসাবা, বাসন্তী, রাঙাবেলিয়া,
মোল্লাখালি, সাতজেলিয়া, লাক্সবাগান, দয়াপুর, লাহিড়ীপুর, আমলামেথী, মন্মত্থ নগর, মথুরাখণ্ড, বালিখাল, ঝাউখালি, কামাক্ষ্যাপুর, বেলতলি, কুমীরমারী, বিপ্রদাসপুর, জেমসপুর সহ সুন্দরবনের বিভিন্ন স্থানে। সেই সব পরিবারগুলিকে অনাহার, অর্ধাহারে দিন কাটাতে হয়। তেমন ভাবে সরকারি সাহায্য মেলেও না। উপেক্ষিত থেকে যেতে হয়। অনেকেই আবার সরকারি অনুদান পাওয়ার জন্য চাতকের মতো তাকিয়ে থাকেন!
সেই অনুদান পাওয়ার আগেই অনেকেরই শশ্মানযাত্রাও হয়ে যায়!প্রত্যন্ত সুন্দরবনে এতে মানুষ বাঘের আক্রমণে মারা গিয়েছে, তার কোন ইয়ত্তা নেই। গোসাবা ব্লকের কাঁটাখালি, মালোপাড়াকে অনেকে বিধবাপল্লি নামে জানেন। এই পাড়ায় বাঘের আক্রমণে স্বামী হারানো বেশির ভাগ মায়েদের বসবাস।আর কয়েকদিন পর শুরু হবে বাঙালির বৃহত্তম দুর্গোৎসব। শিউলির গন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। কাশফুল দোদুল্যমান।
সুন্দরবনের মাথুরাখনণ্ড গ্রামের গীতা সরদার, কল্পনা মণ্ডল, ঝড়খালি গ্রামের লতিকা রায়, আরতি সানাের সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী স্বামীকে বাঘের হানায় হারিয়ে পুজোর আগে নিজের জন্য নতুন শাড়ি কিনতে পারে না। সন্তানদেরও পুজোয় কোনও নতুন পোশাক কিনে দিতে পারে না। নতুন পোশাক তো দূরের কথা, আর্থিক অনটনের মধ্যে কখনও অর্ধাহারে, কখনওবা অনাহারেও কাটাতে হয়।
এইসমস্ত অসহায় বাঘ-বিধবাদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করছেন প্রাক্তন শিক্ষক অমল নায়েক। এবার পুজোর আগে সেই সমস্ত অহায় পরিবারের পাশে দাঁড়ালেন পুজোর উপহার সামগ্রী নিয়ে। তাঁর আহ্বানে সুন্দরবনের ঝড়খালি, বালি, গোসবা, সাতজেলিয়া, কুমিরমারী প্রত্যন্ত দ্বীপ এলাকা থেকে প্রায় ৪০০ বাঘ-বিধবা মায়েরা বাসন্তীর শিবগঞ্জ চম্পা মহিলা সোসাইটির প্রাঙ্গণে সমবেত হন।
বাঘ-বিধবা মায়েদের চিন্ময়ী রূপে মাতৃবন্দনায় সম্মানিত করা হয়। তাঁদের প্রত্যেকের হাতে দু’টি নতুন শাড়ি, কালচ সাপের আক্রমণ থেকে বাঁচতে একটি করে মশারি এবং পুজোর একসপ্তাহের খাবারও তুলে দেওয়া হয়। সুন্দরবনের এই প্রান্তিক অসহায় বাঘ-বিধবা মা, যারা সমাজে অবহেলিত, তাঁদের মাতৃবৃন্দনায় আহ্বান করে তাঁদের হাতে এই পোশাক ও খাদ্যসামগ্রী দেওয়ায় অনেকে আনন্দে চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি।
শুধু তাই নয়, অমলবাবু দীর্ঘদিন ধরে এঁদের সংঘঠিত করে সুন্দরবনের বাঘ, বন্যপ্রাণ, বাদাবন, জীব-বৈচিত্র্য এমনকী সুন্দরবনের নদীবাঁধ রক্ষার লড়াইয়ে সামিল করিয়েছেন। অমলবাবুর দুঃখ, বিপন্ন সুন্দরবন রক্ষার্থে সুন্দরবনের তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ আজও সচেতন হতে পারেননি। তাই এইসব প্রান্তিক মানুষ অর্থাৎ মৎস্যজীবী, মৌলে ও বাঘ-বিধবা মায়েদের নিয়ে সুন্দরবন বাঁচাতে পথে নেমেছেন।