বান্টি মুখার্জি, ক্যানিং: মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মুম্বইয়ের জুহু এলাকার পাঁচতারা হোটেল নভোটেলে এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সিনেমার অভিনেতা তথা বাস্তবের হিরো সোনু সুদ পুরস্কৃত করলেন সুন্দরবনের যুবক প্রসেনজিৎ মণ্ডলকে।
বিগত দিনে আয়লা, ফণি, আম্ফান, ইয়াসের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন প্রসেনজিৎ। পরবর্তী দু’বছর করোনাকালে লকডাউনের সময় উল্লেখযোগ্যভাবে অসহায় মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। এমন মহান কর্মযঞ্জ নজর এড়ায়নি প্রখ্যাত অভিনেতার। সেই কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ অভিনেতা সোনু সুদ সুন্দরবনের যুবক প্রসেনজিৎকে ‘গ্লোবাল ফেম অ্যাওয়ার্ড, ২০২৩’ পুরস্কারির জন্য মনোনীত করেছিলেন।
সুন্দরবনে যুবক প্রসেনজিৎ তাঁর অনন্য অবদানের জন্য গত ৩০ জানুয়ারি নয়াদিল্লির রফি মার্গের স্পিকার হলে পেয়েছিলেন ‘আত্মনির্ভর ভারত বিকাশ রত্ন’ অ্যাওয়ার্ড। পুরস্কার তুলে দিয়েছিলেন পদ্মশ্রী তথা এসবিএস ফাউন্ডেশানের চেয়ারম্যান জিতেন্দ্র সিং শুন্টি।বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপ অরণ্য ম্যানগ্রোভ বাদাবন সুন্দরবন। ১০২টি দ্বীপ আর সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার নদীবাঁধ দিয়ে ঘেরা এই সুন্দরবন।
রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির পশু, পাখি, ৪০০-র অধিক প্রজাতির ম্যানগ্রোভ গাছগাছালি, নদীনালা সহ পৃথিবীখ্যাত রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার, কুমীর, হরিণ, শঙ্খচূড়ের মতো বিষধর প্রজাতির সাপও। এহেন সুন্দরবনের ওপর বার বার প্রাকৃতিক দুর্যোগ আছড়ে পড়ায় বিভিন্ন দ্বীপ লুপ্ত হয়ে গিয়েছে। ধ্বংস হয়েছে প্রচুর ম্যানগ্রোভ অরণ্য। এছাড়াও রয়েছে অজস্র নদীবাঁধের ভাঙন এবং সভ্য মানুষের হস্তক্ষেপে অরণ্যের ম্যানগ্রোভ ধ্বংস করে মাছের ভেড়ি তৈরি করার মতো অজস্র উদাহরণ।
মূলত সুন্দরবনের অধিকাংশ মানুষজন জঙ্গলের ওপর নির্ভরশীল। মাছ, কাঁকড়া, জঙ্গলের কাঠ, মধু সংগ্রহ করে দিন যাপন করে থাকেন। এসব সংগ্রহ করতে গিয়ে অনেকেই আবার বাঘের পেটে চলে গিয়েছেন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারীর মৃত্যুতে অসহায় হয়ে পড়েছে সেই সমস্ত পরিবারগুলি। নদীবাঁধ বাঁচিয়ে সেই সমস্ত অসহায় পরিবারগুলি যাতে বাঁচতে পারে এবং তাঁদের জন্য সাময়িক ভাবে যদি কিছু করা যায়, সেই চিন্তা করে এগিয়ে আসেন প্রত্যন্ত সুন্দরবনের গোসাবা ব্লকের বালি ২ গ্রাম পঞ্চায়েতের পূর্বপাড়ার যুবক প্রসেনজিৎ মণ্ডল।
একদা ওই যুবকের বাবা শ্রীমন্ত মণ্ডল সুন্দরবনের জঙ্গলের নদীখাঁড়িতে সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে মাছ কাঁকড়া ধরে জীবীকা নির্বাহ করতেন। সেই মাছ, কাঁকড়া নিয়ে বাজারে বিক্রি করতেন শ্রীমন্তবাবুর ছেলে প্রসেনজিৎ। এরপর শ্রীমন্তবাবুর কয়েকজন সঙ্গী বাঘের আক্রমণে নিখোঁজ হয়। সেই কথা জানতে পেরে প্রসেনজিৎ চেষ্টা করতে থাকেন সুন্দরবনকে সবুজ করে তুলে অসহায় মানুষের জন্য কিছু করার। প্রায় সাত বছর আগে গড়ে তোলেন সুন্দরবন ফাউন্ডেশন নামে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। এলাকায় বিধবা এবং দরিদ্র অসহায় মায়েদের নিয়ে শুরু করেন নদীবাঁধ বাঁচিয়ে ম্যানগ্রোভ রোপণের কাজ।
কাজের শেষে অসহায় মায়েদের হাতে তুলে দিতেন নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী। আর পিছন ফিরে তাকাতেই হয়নি বালির পূর্বপাড়ার ওই যুবককে।এযাবৎ গোসাবা ব্লকের বালি ২ পঞ্চায়েত এলাকার বিভিন্ন নদীবাঁধে প্রায় পাঁচ লক্ষের অধিক ম্যানগ্রোভ চারাগাছ রোপণ করেছেন।এককথায় সুন্দরবনের গাছপাগল যুবক প্রসেনজিৎ। ম্যানগ্রোভ রোপণের পাশাপাশি এলাকার অসহায় মহিলাদের আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী করে তুলতে মৌমাছি পালন করে মধু চাষও শুরু করেছেন। বর্তমানে এলাকার প্রায় ৫০ জন মহিলা মধু চাষ করে স্বনির্ভর হয়েছেন।
অন্যদিকে, খাদির কাজে নিযুক্ত রয়েছেন ২৫০ জন মহিলা। তাঁরাও আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন। এছাড়াও যে কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগে এবং করোনাকালে প্রসেনজিৎ সুন্দরবন এলাকার অসহায় মানুষের পাশে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। এলাকার মহিলা চন্দনা মণ্ডল, বেহুলা সরদার, পুষ্প মণ্ডল, কণিকা মণ্ডলরা জানিয়েছেন, প্রসেনজিতের মতো প্রকৃতিপ্রেমী যুবক আমাদের এলাকায় না থাকলে করুণ দুর্দশা আরও ফুটে উঠতে। ও-ই আমাদের বেঁচে থাকার লড়াই শিখিয়েছে।
পাশাপাশি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নদীবাঁধ রক্ষা করে সুন্দরবনকে আরও সবুজ করে সুন্দর পরিবেশ গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর। প্রসেনজিতের জন্য আমরা আজ স্বনির্ভর।অন্যদিকে প্রসেনজিতের কথায়, সুন্দরবন আমার মাতৃভূমি। সেই মাতৃভূমি রক্ষা করা আমার এবং আপনাদের সকলেরও দায়িত্ব।সুন্দরবন বাঁচলে আমরা নিশ্চিত ভাবে নিরাপদে বাঁচতে পারবে। বাঁচতে পারবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।
যার জন্য ম্যানগ্রোভ রোপণ অত্যন্ত জরুরি। সেই কাজ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এই কারণে আমাকে ‘গ্লোবাল ফেম অ্যাওয়ার্ড, ২০২৩’ অ্যায়ার্ডে ভূষিত করা হয়েছে। এর জন্য আমি সুন্দরবনবাসী হিসাবে গর্বিত। এই পুরস্কার সকল সুন্দরবনবাসীর। তিনি আরও বলেন, এমন পুরস্কার পাওয়ায় আগামী দিনে দায়িত্ব আরও অনেকখানি বেড়ে গেল।