Thursday, March 28, 2024
Homeজেলাঅর্থের অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে অপূর্বর বাঁশির সুর

অর্থের অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে অপূর্বর বাঁশির সুর

বান্টি মুখার্জি, ক্যানিং: তাঁর বাঁশির সুরে ভোরে ঘুম ভাঙে গ্রামের মানুষের। শিশিরবিন্দুর সঙ্গে ধরণীর কোলে ঝরে পড়ে শিউলি। আবার গ্রামের গৃহবধুরা তাঁর বাঁশির সুরের মূর্ছনায় সন্ধ্যাবেলায় তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বালেন। বছর তেইশের যুবক। নাম অপূর্ব মণ্ডল। ছোটবেলায় বাঁশির সুর শুনে তাঁর বাঁশি বাজানো শেখার ইচ্ছা হয়েছিল। দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিং থানার অন্তর্গত গোপালপুর গ্রামের বাসিন্দা।

অর্থের অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে অপূর্বর বাঁশির সুর

চার ভাই আর এক বোন। পরিবারে সকলের ছোট অপূর্ব।খুব ছোটবেলায় সকলকে ফেলে রেখে অন্যত্র চলে যান অপূর্বর বাবা। সেই থেকে মা উর্মিলা মণ্ডল কলকাতায় পরিচারিকার কাজ করে ছেলেমেয়েদের মানুষ করে চলেছেন। একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন উর্মিলাদেবী।চার ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ জোগাতে পারছিলেন না।

অর্থের অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে অপূর্বর বাঁশির সুর

ফলে একসময় সকলেই পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে জীবিকার সন্ধানে কাজের খোঁজ করতে থাকে। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে অপূর্ব একটু অন্য রকম। ছোট থেকেই বাঁশি বাজানোর জন্য উদগ্রীব। পরে পাড়ার একটি মেলা থেকে বাঁশি কিনে বাজাতে থাকেন। একসময় তাঁর বাঁশির কর্কশ আওয়াজে প্রতিবেশীরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠতেন। এমনকী তাঁরা অপূর্বর বাড়িতে চড়াও হয়ে বাঁশি বাজানো বন্ধের নির্দেশ দেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা!

অর্থের অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে অপূর্বর বাঁশির সুর

অপূর্ব হতে চায় পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার মতো একজন বংশীবাদক। বাঁশিই তাঁর একমাত্র ধ্যানজ্ঞান ও জীবন। বাঁশি বাজিয়ে বড় হতে চান। বাঁশি বাজিয়ে দেশকে বিশ্বমাঝে তুলে ধরতে চান। তাঁকে কে আটকে রাখতে পারে?একদা প্রতিবেশীদের চাপে পড়ে বাঁশি নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন প্রত্যন্ত গ্রামের মাঠের দিকে।

অর্থের অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে অপূর্বর বাঁশির সুর

কখনও সকালে, কখনও বা দুপুরে কিংবা গোধূলি বেলায় এভাবেই বাজিয়ে চলতেন। স্কুলে পড়া না পারলে তাঁর বাঁশির সুর তাঁকে বাঁচিয়ে দিত। শিক্ষক-শিক্ষিকারা তাঁর বাঁশির সুরে মজে যেতেন। বিদ্যালয়ে কোনও অনুষ্ঠান হলে বাঁশি বাজানোর জন্য ডাক পড়তে অপূর্বর। অভাব অনটনের মধ্যে চেষ্টা করেন পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু পরিবারের অর্থনৈতিক সমস্যায় উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি টপকাতে না পেরে থামতে হয় অপূর্বকে।

অর্থের অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে অপূর্বর বাঁশির সুর

ছোট থেকে দু’বার বাঁশি কিনে বাজিয়েছেন। তারপর থেকেই নিজেই বাঁশি তৈরি করে একটু আয়ের পথ তৈরি করেন। সেটা যৎসামান্য। সারা বছরে মাত্র ১২-১৪ টি বাঁশি তৈরির অর্ডার মেলে। এখন অপূর্বর বাঁশির সুর শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন প্রতিবেশী সহ অন্যান্যরা। ছোট থেকেই কোনও তালিম ছাড়া রবীন্দ্রসংগীত, নজরুল গীতি, শ্যামাসংগীত সহ বিভিন্ন গানের সুর তাঁর বাঁশিতে বেজে ওঠে।

অর্থের অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে অপূর্বর বাঁশির সুর

বড় হতে গেলে তালিম প্রয়োজন, উন্নত মানের বাঁশিরও প্রয়োজন। ইচ্ছা থাকলেও হয় না। কারণ অর্থনৈতিক পরিকাঠামো নেই। তবে অপূর্বর পরিচারিকা মা উর্মিলা দেবী চান, তাঁর সন্তান বাঁশি বাজিয়ে একদিন অবশ্যই দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে। কান্নায় ভেঙে পড়ে তিনি বলেন, ছোট থেকেই ওর পাশে কেউ নেই। প্রথমে বাঁশি বাজালে পাড়ার লোকজন অশান্তি করত।

অর্থের অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে অপূর্বর বাঁশির সুর

এখন অবশ্য তারাই প্রতিদিন বাড়িতে এসে অপূর্বর কাছে আবদার করে বাঁশি বাজানোর জন্য। অর্থকষ্টের জন্য কোথাও কোনও তালিম নেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি। দারিদ্রতাই বাধা। যদি কোনও সহৃদয় শিল্পীর সান্নিধ্য পান কিংবা কেউ যদি আর্থিক ভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন, তাহলে সরস্বতীর আশীর্বাদে আমার অপূর্বর অপূর্ব প্রতিভা আরও বেশি করে উন্মোচিত হতে পারে।

অর্থের অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে অপূর্বর বাঁশির সুর

নাহলে হয়তো ওর বাঁশির সুর চিরতরে থমকে যাবে।অন্যদিকে, পাড়াপড়শিরাও চান, অপূর্বর পাশে সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে কোনও শিল্পী বা সংস্থা দাঁড়ালে তাঁর বাঁশির সুর আরও বিকশিত হবে। নাহলে থেমে যাবে তাঁর সুরেলা বাঁশি।

Most Popular